বাংলাদেশের ক্ষুদ্রতম জেলাসমূহের মধ্যে অন্যতম একটি হলো চুয়াডাঙ্গা। ইংরেজিতে বহুল প্রচলিত একটা প্রবাদ আছে “Size Doesn’t Matter” আর সেই সূত্র ধরেই এই ক্ষুদ্রতম জেলাটি বাংলাদেশের সুবৃহৎ ইতিহাসের ভিতর নিজের অন্যতম একটি স্থান করে নিয়েছে। আমাদের মধ্যে যারা যারা ইতিহাস বিষয়ে মোটামুটি জ্ঞান রাখেন অথবা বিসিএস এর প্রিপারেশানের জন্য হলেও বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে কিছুটা ঘাটাঘাটি করেছেন তারা সহজেই স্থান করে নেবার কারন গুলো বলতে পারেন। আর হ্যা… সেই কারন গুলোর মধ্যে সবচে গুরুত্ত্বপূর্ণ হল ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত এ জেলাটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রথম অস্থায়ী রাজধানী। । তবে চলুন, জেলাটি সম্পর্কে বিস্তারিত দুটো কথা জানা যাক।
চুয়াডাঙ্গার নামকরণ নিয়েও রয়েছে নিগূঢ় রহস্য। অনেক স্থানীয় ইতিহাস লেখক তাঁদের বইতে লিখেছেন চুয়াডাঙ্গা নামটা সম্ভবত “চুংগু মল্লিক” এর নাম থেকে এসেছে। চুংগু মল্লিক ছিলেন সাবেক পাকিস্তানি মন্ত্রী এ.এম.মালিকের প্রপিতামহ। আবার অনেকে মনে করেন, চুয়াডাঙ্গা শহরটি ভৈরব নদীর চর হিসেবে জেগে উঠেছিল। ‘চুয়া’ শব্দের অর্থ হলো পরিষ্কার। তাই ভৈরব নদীর তীরের পরিষ্কার ডাঙ্গা বা চুয়াডাঙ্গা হিসাবেও এ জেলাটির নামকরণ হওয়া অসম্ভব নয়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেও রয়েছে চুয়াডাঙ্গার অত্যন্ত সফল পদচারণা। যুদ্ধে কুষ্টিয়া, চুয়াডাংগা, মেহেরপুর তথা বৃহত্তর কুষ্টিয়া অঞ্চলের অবদান ও ভৌগলিক গত অবস্থান বিবেচনা করে চুয়াডাংগাকেই প্রথম রাজধানী হিসেবে বিবেচনাধীন রাখা হয়। ১০ এপ্রিল সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী করে প্রথম সরকার গঠিত হয়। সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবরেও চুয়াডাংগাকে বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। আর নবগঠিত এই সরকার যে চুয়াডাংগাতে শপথ গ্রহন করবে সে কথাও আকাশবাণীতে ঘটা করে প্রচার করা হয়। ফলে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীদের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। এ বিষয়ে ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, “১৪ এপ্রিল ঠিক হয়েছিল চুয়াডাংগায় শপথ গ্রহন অনুষ্ঠান হবে। কিন্তু পাকিস্তানিদের কাছে সে খবর পৌছে গেল। ফলে সাংঘাতিক ভাবে বোমা বর্ষন করা হলো চুয়াডাংগাতে। পরে ঠিক করা হলো মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় (বর্তমান মুজিবনগর) শপথ গ্রহন অনুষ্ঠিত হবে। ” এই প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন সময়ে ৮নং সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান লিখেছেন “চুয়াডাঙ্গাকে অস্থায়ী রাজধানী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় এবং ১০ এপ্রিল গঠিত স্বাধীনবাংলা মন্ত্রীপরিষধকে চুয়াডাঙ্গায় শপথগ্রহন করানো হবে বলোও প্রাথমিক ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়।“ পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসবিদ,সাংবাদিক মোহিত রায় লিখেছেন,“চুয়াডাঙ্গার দেশপ্রাণ তরুণদের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের ফলেই ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গা মুক্ত স্বাধীন ছিল,পেয়েছিল প্রথম রাজধানীর মর্যাদা।“ তাছাড়া চুয়াডাঙ্গা হতে পরিচালিত যুদ্ধে ৩১ মার্চ ১৯৭১ তারিখে কুষ্টিয়া শত্রু মুক্ত হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে চুয়াডাঙ্গার প্রায় অর্ধ শতাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধা মাতৃভূমির জন্য শহীদ হন।
এই জেলার কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস রয়েছে।
যেমনঃ চুয়াডাঙ্গাতেই জন্ম হয় ‘ বাংলাদেশ টেলিফোন বিভাগের’ যার মাধ্যমে আমরা দেশ ও বহি:বিশ্বের সাথে যোগাযোগ করে আসছি। আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় মনোগ্রাম তৈরী করেন চুয়াডাঙ্গার কৃতি সন্তান প্রয়াত এন. এন. সাহা । ২৮ মার্চ ১৯৭১ তারিখে যুদ্ধাহতদের সেবা করার লক্ষে চুয়াডাঙ্গাতেই জন্ম হয় ‘বাংলাদেশ রেড ক্রস’ এর । বর্তমানে UGC ও সরকার অনুমোদিত চুয়াডাংগাতে একমাত্র বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়টির নামও ‘First Capital University Of Bangladesh’। এছাড়াও চুয়াডাঙ্গার কার্পাসডাঙ্গাতে রয়েছে ঐতিহাসিক নীলকুঠি।আবার কার্পাসডাঙ্গাতেই কাজী নজরুল ইসলাম অতিবাহিত করেছেন জীবনের অনেক সময় এবং এ সময়কালে তাঁর হাতে জন্ম নেয় অনেক কবিতা। এছাড়াও রয়েছে চুয়াডাঙ্গাবাসীর জীবনের একাংশ মাথাভাঙ্গা নদী ও ব্রিজ ; যার সুশীতল হাওয়া পুলকিত করে সবার হৃদয়।
কিন্তু আশ্চর্যকর বিষয় হলো মহান মুক্তিযুদ্ধে চুয়াডাঙ্গা নের্তৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করলেও স্বাধীনতার পর এর প্রাপ্য মর্যাদা রাষ্ট্রীয় ভাবে দেওয়া হয়নি। স্বাধীনতার পর থেকেই ১০ এপ্রিলকে চুয়াডাঙ্গাবাসি জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে প্রথম রাজধানী দিবস পালন করলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে তার স্বীকৃতি আজো মেলেনি। তাই চুয়াডাঙ্গা বাসী বরাবরই দাবি করে আসছে ১০ এপ্রিল রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রথম রাজধানী দিবস পালন করা হোক এবং চুয়াডাঙ্গা তাঁর প্রথম রাজধানীর মর্যাদা পাক। প্রতি বছরই হয় মানব বন্ধন, সভা, প্রতিবাদ… ইভেন আমার লেখা কলামই দু’একটা স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকা রঙ্গিন পাতায় ঘটা করে ছেপেছে। কিন্তু আজো কোন ফল পাওয়া যায়নি। কিছু বছর অন্তর অন্তর সরকার বদলাচ্ছে, নীতি বদলাচ্ছে, রাজনীতি বদলাচ্ছে, কিন্তু চুয়াডাংগা বাসীর এই দাবীটির দিকে কখনো কর্ণপাত করা হয় নি। আর আমি ব্যাক্তিগত ভাবে মনে করি যদি চুয়াডাঙ্গাকে ও চুয়াডাংগাবাসীকে তার প্রাপ্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করা হয় তাহলে তা হবে ইতিহাসের প্রকাশ্য একটি সত্যের চরম অবমাননা।